পথের পাঁচালীর ‘প্রসন্ন গুরুমহাশয় বাড়ীতে একখানা মুদীর দোকান করিতেন। দোকানেরই পাশে তাঁহার পাঠশালা ছিল। বেত ছাড়া পাঠশালায় শিক্ষাদানের বিশেষ উপকরণ-বাহুল্য ছিল না।’
সেই পাঠশালায় শিশু অপুর প্রথম যাওয়ার বর্ণনা ছিলঃ
‘মা আসিয়া ডাকিল—অপু, ওঠ শীগগির ক’রে, আজ তুমি যে পাঠাশালায় পড়তে যাবে! পাঠশালার নাম শুনিয়া অপু সদ্য-নিদ্রোত্থিত চোখ দুটি তুলিয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার ধারণা ছিল যে, যাহারা দুষ্টু ছেলে, মা’র কথা শোনে না, ভাইবোনদের সঙ্গে মারামারি করে, তাহাদেরই শুধু পাঠশালায় পাঠানো হইয়া থাকে। কিন্তু সে তো কোনদিন ওরূপ করে না, তবে সে কেন পাঠাশালায় যাইবে?’
‘মানিকগঞ্জে হিট স্ট্রোকে প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু’, ‘তীব্র গরমে শ্রেণিকক্ষেই জ্ঞান হারাল শিক্ষার্থী’, ‘নোয়াখালীতে প্রচণ্ড গরমে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৭ শিক্ষার্থী অসুস্থ’, ‘গরমে অসুস্থ হয়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু’, ‘হিট স্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু’, ‘তীব্র গরমে টিউবওয়েলের পানি পান করে ১৩ স্কুল শিক্ষার্থী অসুস্থ’—এই ধরনের খবর পড়ছিলাম।
ভাবছিলাম, দেশে কয়টা বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে বৈদ্যুতিক পাখা আছে? কয়টি বিদ্যালয়ের ভবনের ওপর রড-সুরকিতে ঢালাই করা ছাদ আছে? কোনো শিক্ষার্থী বা শিক্ষক হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তার তাৎক্ষণিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা দেওয়ার জ্ঞান কয়টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আছে?
ভাবছিলাম, সরকার কি জানে না, সারা দেশে টিনের চালের তলে বৈদ্যুতিক পাখাবিহীন পাঠশালায় লাখ লাখ ‘অপু-দুর্গা’ পড়াশোনা করে? সেই টিনের চাল উত্তপ্ত হলে ক্লাসঘরগুলো যে আস্ত একেকটা লোহা গলানো রি-রোলিং মিল হয়ে ওঠে সে আন্দাজ কি শিক্ষামন্ত্রীর নেই? তাপের চোটে যেখানে রাস্তার পিচ গলে যাচ্ছে, সেখানে এই সব শ্রেণিকক্ষে বসে টেন্স বা সেনটেন্সের পাঠ নিতে গেলে যে কেউ যে সেন্সলেস হয়ে পড়তে পারে, তা বোঝার মতো সেন্স কি বিদ্যানুরাগী কর্মকর্তাদের মাথায় নেই?
‘কিছু হলেই স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার আলোচনা কেন? সবকিছু খোলা থাকবে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে, এ প্রত্যাশা যথাযথ নয়’—শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের এই বক্তব্য ওপরোক্ত ভাবনার পারদকে চড়িয়ে দিচ্ছিল। এরপর স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা নিয়ে একেক মুনির একেক মত দেখছিলাম।
তাপদাহের কারণে বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবরের মধ্যে গতকাল রোববার ঢাকা,চুয়াডাঙ্গা,যশোর,খুলনা ও রাজশাহী-এই ৫ জেলার মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা এল।
তবে এসব এলাকার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ চাইলে প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে পারবে বলে বলা হয়েছিল।
সেই ঘোষণায় প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখার কথা ছিল না। অর্থাৎ প্রাথমিকের পড়ুয়াদের স্কুলে যাওয়ার আদেশ আগের মতোই জারি ছিল।
আজ সোমবার দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় ২ মে পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা এল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরেক ঘোষণায় আগামীকাল মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) দুটি বিভাগের সব জেলাসহ দেশের ২৭টি জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে যে নীতি নির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলা আছে তা এখন মোটামুটি স্পষ্ট।
কারণ এটি নিয়েও হাইকোর্টকে পর্যন্ত রুলিং দিতে হয়েছে। হাইকোর্ট আজ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার ক্লাস আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।
গত ১৯ এপ্রিল থেকে দফায় দফায় ৭২ ঘণ্টার ‘তাপ সতর্কতা’ জারি করে যাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তার মানে একটা প্রাকৃতিক জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। একটা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
আবহাওয়া দপ্তরও বলে যাচ্ছে, তাপপ্রবাহ দু একদিনের মধ্যে কমার কোনো লক্ষণ নেই। এই বাস্তবতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সরকারের ব্যাগ্রতার বাহুল্য শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে আমাদের অনেকের মনে যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন করছে।
রুটি-রুজির জন্য অনেক লোককে রিকশা চালনা কিংবা এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে। এসব কাজ করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই কয়েকজন হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
যেখানে জীবন-জীবিকার প্রশ্ন, সেখানে হয়তো পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করা বা ন্যূনতম ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখানো যেতে পারে।
কিন্তু তাপদাহের মতো তুলনামূলক ক্ষণায়ু দুর্যোগের মধ্যে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যায়তনে ছাত্র-ছাত্রী পাঠানো নিয়ে কেন ‘অন-অফ’ টাইপের সিদ্ধান্ত আসবে সেটি আমার মতো অনেকেরই মোটা মাথায় ঢুকছে না।
শিক্ষামন্ত্রী রোববার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘কিছু হলেই প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে, এ ধারণা রাখা চলবে না। আমাদের নতুন কারিকুলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক; তাই শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে আসা জরুরি।...ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বিবেচনা করে সারা দেশের বিদ্যালয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে।’
যে মুহূর্তে দেশের প্রায় সবখানে মানুষ তীব্র গরমে অতিষ্ঠ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে, সে মুহূর্তে শিক্ষামন্ত্রীর এই বিপ্লবী বিদ্যোৎসাহ এবং স্কুল খোলা নিয়ে সরকারের দফায় দফায় সিদ্ধান্ত দেওয়া পীড়াদায়ক।
সরকারকে বুঝতে হবে, আমাদের কারও হাত নেই এমন একটি খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়েছি। এই পরিস্থিতি খুবই সাময়িক।
করোনায় টানা দুই বছর শিশুরা স্কুলে যেতে পারেনি। তাতে যখন মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি, তখন এই তাপদাহে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে পাঠানো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না হলেও চলবে।
প্রথমে ‘হীরক রাজার দেশে’র উদয়ন পণ্ডিতের মতো করে বলি, ‘পাঠশালা খুলবেই’; পরে একজন জনপ্রিয় রাজনীতিকের মতো করে বলি, ‘এ নিয়ে রাজনীতির কিছু নেই।’
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 500,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).