চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে উচ্চ স্বরে যে আলোচনা ও উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় ছিল পুলিশ সংস্কার এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। কিন্তু যেভাবে এই উদ্যোগকে অকার্যকর করার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রসংস্কারের বিষয়টি ‘ফাঁকা বুলিতে’ পরিণত করা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটিই সামনে চলে আসে। পুলিশ কমিশন ও দুদক সংস্কারের যে দুটি খসড়া তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোর ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। এটা কেবল প্রশাসনিক অনীহা নয়; বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুরোনো ক্ষমতাকাঠামোকে অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা।
খবর জানাচ্ছে, পুলিশ কমিশন নিয়ে উপদেষ্টাদের কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা নিখুঁত না হলেও অন্তত সংস্কারের একটি ন্যূনতম দিকনির্দেশনা ছিল। আইজিপি নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার জন্য কমিশনের প্যানেল গঠনের ক্ষমতা, নিয়োগ–পদোন্নতি–বদলিতে রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর নীতিমালা প্রণয়নের সুযোগ এবং বিচারপতি স্তরের সমমর্যাদার সদস্য নিয়ে একটি স্বশাসিত কমিশন—এসব ধারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশের দিকে যাত্রার একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল।
কিন্তু খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানোর পর ভিন্নভাবে ফিরে এল। খসড়া থেকে বাদ পড়ে আইজিপি নিয়োগে স্বচ্ছতার সুরক্ষা, বাদ পড়ল নীতিমালার বাধ্যবাধকতা, বাদ পড়ল স্বাধীন কাঠামো। ৯ সদস্যের স্বশাসিত কমিশনকে ছেঁটে ৭ জন করা হয় আর কমিশন সদস্যদের বিচারপতি সমমর্যাদা সরিয়ে ‘সরকার নির্ধারণ করবে’, এমন অস্পষ্ট, ক্ষমতানির্ভর সূত্র বসানো হয়। ফলে কমিশন গঠিত হওয়ার আগেই সেটা অকার্যকর হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, পুরো প্রক্রিয়াটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিলম্বিত করার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুসারে, মন্ত্রণালয় কখনোই পুলিশের ওপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে আগ্রহী ছিল না। আইজিপির নিজের ভাষায়, এটি ২০০৭ সালের পুনরাবৃত্তি—তখনো পুলিশ কমিশনের উদ্যোগ নিয়ে মন্ত্রণালয় তা বছরের পর বছর ধরে আটকে রেখেছিল। কমিশন থাকবে, কিন্তু সেটা ক্ষমতাহীন হবে—এমন ‘লোকদেখানো’ সংস্কারের অর্থ কী?
একই চিত্র দেখা গেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কারের ক্ষেত্রেও। দুদক জন্মলগ্ন থেকেই জন–আস্থার সংকটে ভুগেছে। কারণ, ক্ষমতাসীনেরা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নানাভাবে হেনস্তা করতে দুদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠন। জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী সব রাজনৈতিক দল সম্মত হয়েছিল যে কমিশনারদের নিয়োগে ক্ষমতাসীনদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে আনা হবে। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এই প্রক্রিয়া অন্তত কিছু মাত্রায় দুদককে রাজনৈতিক চাপ থেকে দূরে রাখার সুযোগ দিত।
কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এই সুপারিশই বাদ দেওয়া হলো। টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি) স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকের বক্তব্য অনুযায়ী, অন্তত সাতজন উপদেষ্টা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন, যা দুই দশকের ব্যর্থতার পরও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলের ভেতরে দুর্নীতি-সহায়ক বলয়ের শক্ত অবস্থানকে প্রকাশ করে। যে সুপারিশে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য ছিল এবং রাষ্ট্রসংস্কারের মূল অঙ্গীকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল, সেটি বাদ দেওয়ার মাধ্যমে সরকার কার্যত উল্টোযাত্রা করেছে।
এ দুটি সংস্কার উদ্যোগের সার্বিক চিত্র মিলিয়ে যে বার্তা তৈরি হচ্ছে, তা খুবই অস্বস্তিকর। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে পুরোনো কাঠামোকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর একটি গোষ্ঠী কোনোভাবেই সংস্কার চায় না। তবে সংস্কারের সুযোগ এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। উপদেষ্টা পরিষদ খসড়া দুটি পুনর্বিবেচনার জন্য ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা আশা করি, জন–আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ, দুদকসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর সত্যিকারের সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করবে।
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 10,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).