বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে। তবে ১৯৯০-পরবর্তী গণতান্ত্রিক যুগের সূচনায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমকাঠামো, বিষয়বস্তু, ব্যবহার ও মালিকানায় নানা পরিবর্তন দেখা যায়। নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ও বিশ্বায়নের অনস্বীকার্য প্রভাবে এ দেশের সংবাদমাধ্যমও প্রভাবিত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের উল্লম্ফন হলেও নিয়ন্ত্রিত বাজার ও করপোরেট পুঁজির প্রভাব, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রীয় নানা আইনি ও নীতিকাঠামো এবং এর ফলস্বরূপ ‘সেলফ সেন্সরশিপ’-এর মতো নানা চ্যালেঞ্জের কারণে পেশাদার ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা নিবিড় হয়নি। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় নানা আইনি ও নীতিকাঠামো বর্তমানে সংবাদমাধ্যম ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।
এসব আইন যেকোনো সময় যেকোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবহারের হুমকি সাংবাদিকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩, এবং পেনাল কোড ১৮৬০-এর বিভিন্ন ধারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদাহরণ আছে। এসব আইনে ব্যক্তির মানহানি, মিথ্যা তথ্য প্রকাশ, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা লঙ্ঘন কিংবা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর বিবেচনায় মামলা করার সুযোগ আছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অন্তত নয়টি আইন প্রয়োগ হচ্ছে, যার সবশেষ সংস্করণ ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন; যদিও সম্প্রতি এর নাম ও কিছু ধারা পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। তবু তা গণমাধ্যম, সাংবাদিকতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য হুমকি হিসেবেই থেকে গেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, আগের আইসিটি আইন ২০১৩-এর অধীনে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ ১ হাজার ৩০০ মামলা নথিবদ্ধ করে, যার বেশির ভাগই বিতর্কিত ৫৭ ধারায় করা। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর অধীনে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে (সূত্র: ৫ জুন ২০২৩-এ জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক)। অর্থাৎ এই আইনের অধীন প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চারটি মামলা হয়েছে।
পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে নতুন নামে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ প্রণীত হলেও এতে কিছু শাস্তি হ্রাস ও ব্যাখ্যা প্রদানের বাইরে পুরোনো দুই আইনের বেশির ভাগ নিবর্তনমূলক ধারাই হুবহু কিংবা ভিন্ন ভাষায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে। মানহানির মতো কিছু ‘অপরাধের’ ক্ষেত্রে জেলের পরিবর্তে জরিমানার পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে অজামিনযোগ্য বিভিন্ন ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সূত্রে জানা যায়, নতুন এই আইনে ১৭, ১৯, ২৭, ৩০ ও ৩৩-এর মতো অন্তত ৬টি ধারা এখনো অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। ফলে ‘সাইবার স্পেসে’ নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য যে আইনের জন্ম, তা এখনো উদ্দিষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেয়ে সংবিধানবদ্ধ বাক্স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার, বিশেষ করে সাংবাদিকতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য হুমকি হয়ে আছে।
অন্যদিকে ক্রমাগত হামলা-মামলা ও হুমকির মুখে সংবিধান প্রদত্ত সংবাদ ও মত প্রকাশ তথা বাক্স্বাধীনতার অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার ফলে বিগত বছরগুলোতে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানসমূহে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের বিধিনিষেধ না থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানই নিজের মতো করে সরকার, রাজনৈতিক দল কিংবা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন প্রতিবেদন প্রকাশে বিরত থাকেন কিংবা কাটছাঁট করে প্রকাশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ সালের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা প্রায়ই অভিযোগ করেছেন, তাঁদের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও সম্পাদকেরা বিভিন্ন ‘চাপের ভয়ে’ তাঁদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো ‘হত্যা’ (ছাপায়নি বা প্রকাশ করেনি) করেছে।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সাংবাদিকদের জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র। ১৯৯২ সাল থেকে অন্তত ৩৪ সাংবাদিক পেশাগত কারণে নিহত হয়েছেন। সাংবাদিকদের অবাধে সংবাদ প্রকাশের সীমাবদ্ধতা, সীমিত বাক্স্বাধীনতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার ফলস্বরূপ গণমাধ্যম, মত প্রকাশ ও মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি হচ্ছে।
যেমন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) কর্তৃক প্রকাশিত ২০২৩ সালের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমাবনতি হয়ে ১৬৩তম, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আরএসএফের প্রতিবেদনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অতি সংকটজনক, অসুবিধাজনক, সমস্যামূলক, সন্তোষজনক ও ভালো—পাঁচটি শ্রেণির মধ্যে বাংলাদেশ ‘অতি সংকটজনক’ শ্রেণিতে (পরিস্থিতিতে) আছে।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও বাক্স্বাধীনতার জন্য প্রতিবন্ধক যত আইন আছে, এর বেশির ভাগ ১৮৬০ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধি দ্বারা প্রভাবিত। এই দণ্ডবিধির ১২৪-এর ‘ক’ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কথায়, লিখে, কোনো চিহ্ন বা প্রতীক দিয়ে সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, তাকে যাবজ্জীবন বা এর কম মেয়াদের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।
আইনটি ১৬৩ বছর আগে ব্রিটিশ উপনিবেশকালে প্রণয়ন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ কমনওয়েলথের প্রায় সব দেশ এ আইন অনেক আগেই বাতিল করেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও পাকিস্তানে লাহোর হাইকোর্ট এ আইনকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল ঘোষণা করেছে। এ অঞ্চলে শুধু বাংলাদেশে এ আইন বা এর দ্বারা প্রভাবিত আইন প্রবলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শতাব্দীপ্রাচীন এসব আইনের ব্যবহার সংবিধানস্বীকৃত বাক্স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে, তথ্য ও সংবাদ প্রকাশ কঠিন করে তোলে, এমনকি সাংবাদিকতাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।
তাই সাংবাদিকতা, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও বাক্স্বাধীনতা অবাধ করতে অবিলম্বে দণ্ডবিধি ১৮৬০-সহ সংশ্লিষ্ট সব আইন ও বিধি, বিশেষ করে সাইবার নিরাপত্তা আইন, খসড়া গণমাধ্যমকর্মী আইন ঢেলে সাজানো এবং আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রণয়ন কিংবা পুনঃপ্রণয়ন জরুরি।
এ ছাড়া গণমাধ্যমসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালাসমূহ (সম্প্রচার নীতিমালা, অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা, সংবাদপত্র নীতিমালা এবং চলচ্চিত্র নীতিমালা) আলাদাভাবে প্রণয়ন না করে সব ধরনের গণমাধ্যমের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা থাকা প্রয়োজন, যা গণমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন ও সত্যিকারের স্বাধীনতা নিশ্চিতের পাশাপাশি উৎকর্ষ সাধনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কারণ, বাক, মত ও চিন্তার স্বাধীনতার বিকল্প শুধু এর পূর্ণ স্বাধীনতাই হতে পারে। বিরুদ্ধমত দমনের মাধ্যমে কখনোই কোনো উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে না।
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 100,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).