একই দিনে তিনটি ঘটনা সারা দেশকে আলোড়িত করেছে। একটি ঘটনা বুধবারের। ওই দিন ঢাকার মিটফোর্ডে পৈশাচিক উপায়ে একজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুধু হত্যাই করা হয়নি, হত্যার পর লাশের ওপর উঠে নাচানাচিও করেছে খুনিরা।
ভয়ংকর সব দৃশ্য। এই হত্যার দৃশ্য দেখা যায় না। এ ঘটনায় সম্পৃক্ত যুবদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
এ ছাড়া শুক্রবার খুলনায় নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় যুবদলের বহিষ্কৃত এক নেতাকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাড়ির সামনে ৯টি গুলির পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে পায়ের রগ কেটে দিয়েছে খুনিরা।
চাঁদপুরে আরেকটি ঘটনায় মসজিদের এক খতিবকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ওই খতিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করেছেন।
জুমার নামাজে খতিব সাহেব বয়ান দেওয়ার পর চাপাতি নিয়ে হামলা করেন মুসল্লির বেশে আসা হামলাকারীরা। হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তিনটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। মিটফোর্ডের ঘটনার পেছনে রয়েছে এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি। নিহত ব্যক্তি নিজেই ২০০৬ সালে একজনকে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, কিছুদিন হাজি সেলিমের সন্ত্রাসী বাহিনীতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। খুলনার হত্যার কারণ হতে পারে রাজনৈতিক রেষারেষি। কারণ, খুন হওয়া ব্যক্তি কুয়েটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মারামারিতে রামদা নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন। আর চাঁদপুরের ধর্ম অবমাননার অভিযোগ।
পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও এসব ঘটনা প্রমাণ করে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। সারা দেশে প্রতিনিয়তই খুন, জখমের বিবরণ আমরা শুনছি।
সার্বিক পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলাবিহীন এক অন্ধকার সময় অতিক্রম করছি আমরা। সরকার চরমভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরাধীরা মোটেই কাউকে তোয়াক্কা করছে না। সারা দেশে একধরনের অ্যানার্কি বা নৈরাজ্যবাদ চলছে। সবকিছু এখন নৈরাজ্যবাদীদের দখলে চলে গেছে।
আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব নৈরাজ্যবাদী অপরাধীদের সরকারের আচরণও উসকে দিচ্ছে। সারা দেশে একধরনের ‘মবতন্ত্র’ কায়েম হয়েছে, এটা এখন আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সরকার ‘মব’ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
সরকার খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণ করছে। মবকে সরকারের দায়িত্বশীলরা ‘প্রেশার গ্রুপ’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ কারণে মবতান্ত্রিকেরা আরও শক্তি অর্জন করছে।
সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দায়িত্বশীলেরা মব, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রেশার গ্রুপের মধ্যে বিভাজন গুলিয়ে ফেলছেন। বরং দেশের মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সরকারের একটি অংশ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে আড়াল থেকে মব, নৈরাজ্যবাদকে উসকানি দিচ্ছে। প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ না নিয়ে ঘোলাটে অবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে তারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানই বিষয়টি প্রমাণ করে। এই পরিসংখ্যান মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়; বরং ভয়ংকর এক হিমশীতল করা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তুলে ধরে।
পুলিশের হিসাব অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ঢাকায় ১৩৬ জন খুন হয়েছেন। এ সময়ে হত্যার শিকার হয়েছেন সারা দেশে ১ হাজার ২৪৪ জন। উল্লিখিত সময়ে ঢাকায় ২০২১ সালে ৫৫ জন, ২০২২ সালে ৫৪, ২০২৩ সালে ৫১ এবং ২০২৪ সালে ৪৭ জন খুন হয়েছিলেন। চলতি বছর সারা দেশে জানুয়ারিতে ২৯৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩০৮, মার্চে ৩১৬ ও এপ্রিলে ৩৩৬ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। কেবল জানুয়ারিতেই গত বছরের তুলনায় তিন গুণ মানুষ খুন হয়েছেন।
পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, হরেদরে মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে দেশে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ, আপনি অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে যে কেউ আপনাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে এবং আপনার পরিবার কোনো প্রতিকার পাবে না।
সরকার কেবল ব্যস্ত সংস্কার নিয়ে। এর সঙ্গে রয়েছে বিদেশিদের বন্দর প্রদান, করিডর দেওয়া, বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চাভিলাষী নীতি প্রণয়ন করা। মনে হচ্ছে, সংস্কার ও এসব ছাড়া সরকারের আর কোনো কাজ নেই। আইনশৃঙ্খলা, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকার পুরোপুরি উদাসীন।
এই হত্যাযজ্ঞের শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে একজনকে পিটিয়ে মারার মধ্য দিয়ে। এরপর একে একে হত্যার শিকার হয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পারভেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাম্য।
এখন এই হত্যাযজ্ঞ সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুদিন আগে কুমিল্লায় মাদক ব্যবসায়ী অভিযোগে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
কেরানীগঞ্জে ভোরে নামাজের পর পুকুরপাড়ে হাঁটার সময় এক বিএনপি নেতাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরও বেশ কয়েক দিন আগে কেরানীগঞ্জে একজনকে হত্যা করা হয়। পরিবারের লোকজন কী কারণে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে, তার হদিস করতে পারছেন না। মামলা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাও কারণ বের করতে হয়রান হচ্ছেন বলে ওই খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজনেরা জানিয়েছেন।
থানা, পুলিশ কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। হত্যার ধরন কমবেশি একই। গুলি করার পর কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। রগও কাটা হয়।
ফলে সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। হত্যাকারী বা অপরাধী যে দলেরই হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি লক্ষ করা যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে।
রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকুক। অনেকেই এসব হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে সুবিধা নিতে চাইবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও পাল্টা জবাব দেবে। কিন্তু সরকার কী করছে?
অভিযোগ রয়েছে, অনেক হত্যাকাণ্ড, মারামারির সঙ্গে বিএনপির নেতা–কর্মীরা জড়িত। বিএনপি দলীয়ভাবে এসব নেতা–কর্মীকে বহিষ্কারও করেছে। এ পর্যন্ত বিএনপি প্রায় চার হাজারের মতো নেতা–কর্মীকে শৃঙ্খলাবহির্ভূত কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার করেছে।
কিন্তু তারপরও বিএনপির থেমে থাকার সুযোগ নেই। কেবল বহিষ্কার করেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এতসংখ্যক নেতা–কর্মীকে বহিষ্কার করার পরও কেন তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছেন, তা অনুসন্ধান করতে হবে দলটিকে।
দলের শীর্ষ পর্যায়ে এসব উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীর বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার সতর্ক করার পরও কেন নেতা–কর্মীদের কেউ কেউ বিষয়টি কানে তুলছেন না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
যাঁরা এসব অপরাধী নেতা-কর্মীদের আড়াল থেকে আশকারা দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে দলটির প্রতিপক্ষ ঘায়েল করার অস্ত্র হাতে পেয়ে যাবে।
বিএনপিকে আরও কঠোর হতে হবে। সারা দেশে বিশাল জনসমর্থন আছে। কিন্তু কিছু নেতা-কর্মীর এহেন কর্মকাণ্ড এই বিশাল জনসমর্থনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তাঁরা দলের কোনো উপকারেই আসছেন না, বরং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। তাঁরা দলের বোঝা। অন্যদের সমালোচনার সুযোগ করে দিচ্ছেন। তাই গুটিকয়েক সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাদের দল থেকে বের করে দিলে বিএনপির কোনো ক্ষতিই হবে না।
বরং জনসাধারণ আরও আশ্বস্ত হবে যে বিএনপি দুর্জনদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও কোনো দ্বিধা করছে না।
বিএনপির উচিত অতিদ্রুত একটি শক্তিশালী ডিসিপ্লিনারি ও লিগ্যাল টিম গঠন করা। ডিসিপ্লিনারি টিম উচ্ছৃঙ্খল নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর দলের এসব তথাকথিত নেতা–কর্মী দ্বারা কেউ ক্ষতির শিকার হলে লিগ্যাল টিম তাঁদের আইনি সহায়তা প্রদান করবে।
অপরাধের সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে। লিগ্যাল টিম ওই মামলা পরিচালনা করবে দলের পক্ষ থেকে। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, তারা জনগণের দল। এই দল নিয়ে অন্যান্য দলের অপপ্রচার ও কুৎসা রটানোর পথ বন্ধ করে দিতে হবে।
আজকে সারা দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। বিএনপির সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িয়ে গেছে। বিএনপি যদি শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করতে পারে, তাহলে দেশের লাভ হবে। আর বিএনপি দুর্বল হলে দেশ ঝুঁকির মুখে পড়বে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কেউ কেউ বিএনপিকে দুর্বল করতে চাইছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়েছে দলের উচ্ছৃঙ্খল নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকারের ভেতরের একটি অংশ এটা করতেই পারে। তারা চাইতেই পারে বিএনপি দুর্বল হয়ে যাক।
এ ধরনের পরিকল্পনা রোধ করতে বিএনপির পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে এবং উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।
পরিশেষে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি দেশবাসীকে চরমভাবে হতাশ করেছে। শুধু বিএনপি বা অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
অপরাধী যে–ই হোক, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মিটফোর্ডের ঘটনার পর অপরাধীদের নিয়ে শুক্রবার সারা দেশে সমালোচনা শুরু হলে পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে। মাঝের দুই দিন তাহলে পুলিশ কী করল?
বিষয়টি যদি জানাজানি না হতো, তাহলে কি আটক করা হতো না? নাকি ইচ্ছা করেই কালক্ষেপণ করা হয়েছে, যেন বিষয়টি একটি ইস্যু বানানো যায়। তাহলে বিএনপির অভিযোগের সত্যতা মেলে।
অভিযোগ করার পরও সরকার ইচ্ছা করেই ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাই এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দায় সরকারের ওপরই বর্তায়। সরকার কোনোভাবেই এই দায় এড়াতে পারবে না।
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 100,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).