গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের কাছে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিল ‘সংস্কার’। বিশেষ করে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার। এই সরকার এবং সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন সারাক্ষণই বলছে যে তারা সংস্কার করবে। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি?
এখন পর্যন্ত এটিই পরিষ্কার হয়নি যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা কী কী সংস্কার করতে চায়। অনেকগুলো সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিবেদনগুলোয় বাস্তবায়নযোগ্য যেসব সুপারিশ আছে, সেগুলো এখন পর্যন্ত আমরা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে দেখছি না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরং আমরা অতীতের ধারাবাহিকতাই দেখতে পাচ্ছি। সংস্কার হবে, সংস্কার হবে—এ কথা খুব শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু এখানে একটি অস্পষ্টতার জায়গা থেকে গেছে। সংস্কারের বিষয়বস্তুগুলো নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জনগণ বুঝতে পারছে না, কীভাবে সেগুলো বাস্তবায়িত হবে।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার আমরা পেলাম, তাদের কাছে সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কোন বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা? শিক্ষা, চিকিৎসা খাত এবং বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও শিল্পাঞ্চলে তাঁদের নিরাপত্তা। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কোনো ধরনের পরিবর্তনের সূচনা আমরা এখন পর্যন্ত দেখিনি।
গত বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে যা বরাদ্দ ছিল, সংশোধিত বাজেটে তা বরং আরও কমানো হয়েছে। শিক্ষা খাতে বাজেটের যে বরাদ্দ আছে, তা জিডিপির শতকরা ৬-৭ ভাগ করতে হবে—এ দাবি বহু বছর ধরে বাংলাদেশে আছে। কিন্তু বরাবরই আমরা দেখে আসছি, সেটি থাকে ১ থেকে ২ ভাগের মধ্যে। বর্তমান বাজেটেও পরিমাণ–অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু অর্থ বরাদ্দ পরিমাণগত দিক নয়, গুণগত পরিবর্তনের দাবিও ছিল। শিক্ষা ও চিকিৎসা যাতে জনগণের অধিকারের মধ্যে আসে, সে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাসহ অন্যান্য গুণগত পরিবর্তন জরুরি ছিল, সেটির সূচনাই হয়নি গত ১০ মাসে।
শ্রমিকদের এখন পর্যন্ত বকেয়া মজুরির জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। সরকার এর মধ্যে ১৮ দফা চুক্তি করেছিল শ্রমিকদের সঙ্গে। তার বাস্তবায়ন হয়নি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, অনেকগুলো কারখানা সরকার বন্ধ ঘোষণা করায় লাখখানেক শ্রমিক বেকার হয়েছেন। যাঁদের কর্মসংস্থান ছিল, তাঁদের কর্মসংস্থান নষ্ট হয়েছে এবং নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিও হয়নি। এ হিসাবে বলা যায়, গত ১০ মাসে বেকারত্ব বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন দরিদ্রও তৈরি হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে আরও লাখ লাখ মানুষ।
একই ধরনের মামলা দেওয়া হচ্ছে। পাইকারিভাবে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড চলছে। কাউকে জামিন দেওয়া হচ্ছে, কাউকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধীদের নির্দোষ প্রমাণের একটা প্রক্রিয়াও নানা দিকে আমরা দেখছি। সামগ্রিকভাবে বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, স্বাধীনতা ও সক্ষমতা নিয়ে আগে থেকে যে সমস্যা ছিল, সেটা এখনো অব্যাহত আছে।
সংস্কারের ক্ষেত্রে মূল মনোযোগ কোথায় দিতে হবে, সেটির অনুপস্থিতি বা অভাবের কারণে এ বিষয়গুলো ঘটেছে। যেসব জায়গায় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, সেটি করা হয়নি। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। আমরা গত সরকারের সময় দেখেছি যে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা না বাড়িয়ে সব কটি প্রতিষ্ঠানকে আদেশক্রমে চালানো হতো। মানে ওপর থেকে যা আদেশ আসবে, সেই অনুসারে চলতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গতিশীলতা ও সক্ষমতার শক্তিকে এখানে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, প্রশাসন, সরকারি-বেসরকারি সব কটি প্রতিষ্ঠানে এই দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল কিছু নতজানু মেরুদণ্ডহীন গোষ্ঠীর কারণে। এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল, মানে সংস্কারের একটা বড় জায়গা ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্রিয়তা বাড়ানো, সক্ষমতা তৈরি করা এবং নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে অন্য জায়গাগুলোর স্বচ্ছতা আনা। এসব ক্ষেত্রেও আমরা কোনো পরিবর্তন দেখছি না। আমরা দেখছি, জোরজবরদস্তি করে লোকজন বসানো হচ্ছে বা নামানো হচ্ছে। বিচারব্যবস্থায়ও দেখতে পাচ্ছি আগের মতোই চলছে। একই ধরনের মামলা দেওয়া হচ্ছে। পাইকারিভাবে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড চলছে। কাউকে জামিন দেওয়া হচ্ছে, কাউকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধীদের নির্দোষ প্রমাণের একটা প্রক্রিয়াও নানা দিকে আমরা দেখছি। সামগ্রিকভাবে বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, স্বাধীনতা ও সক্ষমতা নিয়ে আগে থেকে যে সমস্যা ছিল, সেটা এখনো অব্যাহত আছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো জনগণের আরেকটি বড় প্রত্যাশা ছিল। আমরা সব সময় বলে এসেছি, এ খাতে জাতীয় সক্ষমতা যদি বাড়ানো হয়, তাহলে সেখানে ভর্তুকি দরকার হবে না। অনেক কম দামে আমরা গ্যাস পাব। অনেক কম দামে আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি পাব। অনেক কম দামে আমরা বিদ্যুৎ পাব। পরিবেশও বিনষ্ট হবে না। এ পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব, যদি জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো হয়। গত সরকার সেটা করেনি। তারা বিদেশি ঋণ, বিদেশি প্রকল্প, আমদানিনির্ভরতা—এসবকেই তাদের নীতি বানিয়ে ফেলেছিল। মূলত কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
বর্তমান সরকারের কাছে আমরা আশা করেছিলাম, জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে তারা মনোযোগ দেবে। কিন্তু সেটি করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ ও নীতিমালার পরিবর্তন দরকার। সেসবের পরিবর্তনের সূচনা দেখা যায়নি। সরকার পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্পগুলো বাতিল করে দিয়ে এর সূচনা করতে পারত; বরং উল্টোটাই আমরা দেখছি। জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর পরিবর্তে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা কিংবা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার দিকেই হাঁটছে সরকার। তার মানে, ওই আমদানি কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ, বিদেশি কোম্পানি, বিদেশি ঋণনির্ভরতা—এ ধারাই অব্যাহত রয়েছে।
সামাজিক ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেমন সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। এটি আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। বম জাতিগোষ্ঠীর অনেককে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও আছে। তাদের কাউকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। মৃত্যুর আগের দিন ক্যানসারে আক্রান্ত বম জাতিগোষ্ঠীর এক ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া হয়েছে। ক্যানসারে তাঁর শরীর কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল, এরপরও তাঁকে জামিন দেওয়া হয়নি। বন্দী অবস্থায় সুচিকিৎসা পাননি, ধুঁকে ধুঁকেই মারা গেলেন তিনি।
পাশাপাশি আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি, সমাজে যে নারীরা একটু সরব হচ্ছেন বা গণ-অভ্যুত্থানে যে নারীরা সরব ছিলেন, তাঁদের ক্রমাগত থামিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। কিছু গোষ্ঠী হুমকি দিয়ে, গায়ের জোর দেখিয়ে, কুৎসা রটিয়ে এসব করে যাচ্ছে। নরসিংদীতে কলেজশিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিনের ক্ষেত্রে এবং আরও বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের ঘটনাগুলো দেখা যাচ্ছে।
দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সরকার এসব বিষয়ে খুবই নির্লিপ্ত। অথবা দেখা যাচ্ছে, সেসব গোষ্ঠীর প্রতিই নীরব সমর্থন জানাচ্ছে। এখনো বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর, জবরদস্তি বা মব ভায়োলেন্স—এসব ঘটছে। মানে হিংসা-বিদ্বেষবাদী, বৈষম্যবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর উত্থান এবং তাদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, যার ফলে মনে হচ্ছে যে নতুন একটি ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে শক্তি অর্জন করছে।
সংস্কারের জন্য সরকারের যেসব কাজ করার কথা, সেগুলো না করে তারা এমন সিদ্ধান্ত ও নীতি গ্রহণ করছে, সেখানে কোনো পরিবর্তনের সূচনা না হওয়ায় তার প্রতিফলন আমরা যেমন অর্থনীতির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, একইভাবে রাজনীতি ও সমাজের মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি। সে জন্য বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যাঁরা স্বপ্ন দেখেছেন ও প্রত্যাশা করেছেন, তাঁদের সজাগ থাকা, সতর্ক থাকা ও সক্রিয় থাকাটা এখনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 75,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).