বাংলাদেশে খুন একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পুলিশের তথ্য বলছে, গত ১৬ বছরে দেশে খুন হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ, অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে প্রায় চার হাজার। কিন্তু নৃশংস এই অপরাধের বিচারের চিত্র ভয়াবহ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) গবেষণায় দেখা গেছে, খুনের মামলার অর্ধেকের বেশি আসামি শেষ পর্যন্ত খালাস পেয়ে যান।
এ চিত্র কেবল হতাশাজনক নয়, ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। খুনের মতো চূড়ান্ত অপরাধে দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি থেকে বাঁচলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে সমাজে। আইনের শাসন দুর্বল হয়, অপরাধীদের সাহস বাড়ে এবং সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
পিবিআইয়ের গবেষণায় খালাসের পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে: বাদী–বিবাদীর সমঝোতা, মামলার এজাহার ও তদন্তের ত্রুটি, সাক্ষীদের অনুপস্থিতি বা ভয়ভীতি এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা।
খুনের মতো অপরাধে সমঝোতার সুযোগ আইনত নেই। তবু সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ, এমনকি আর্থিক প্রলোভনের কারণে বাদী ও বিবাদী আদালতের বাইরে সমঝোতায় পৌঁছান; আদালতে সাক্ষীরা মিথ্যা সাক্ষ্য দেন বা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। এর ফলে রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তদন্তপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা আরও বড় সমস্যা। অদক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা, রাজনৈতিক প্রভাব, আলামত সংগ্রহে অবহেলা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও এজাহারের অসংগতি, জবানবন্দি সঠিকভাবে না নেওয়া—এসব কারণে মামলা দুর্বল হয়ে যায় এবং আসামিরা খালাস পান।
গবেষণায় দেখা গেছে, খুনের মামলার রায় হতে গড়ে ১১ বছর সময় লাগে। এই দীর্ঘসূত্রতা মামলার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সাক্ষীরা মারা যান, স্থান ত্যাগ করেন বা ভয়ভীতি ও প্রলোভনে নীরব হয়ে যান। এমনকি দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার ফাঁকে বাদী-বিবাদীর মধ্যে সমঝোতাও ঘটে। এর ফলে অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যান।
যখন হত্যা মামলার আসামিরা খালাস পান, তখন দুটি ভয়াবহ বার্তা যায়। প্রথমত, হত্যার শিকার পরিবারের কাছে ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, সমাজে বার্তা যায় যে প্রভাবশালীরা বা অর্থশালী আসামিরা শাস্তি এড়াতে পারেন। ফলে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যায়। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট। রাজনৈতিক খুনের মামলায় বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত খালাস পেয়ে যান। এতে রাজনৈতিক সহিংসতার সংস্কৃতি টিকে থাকে।
খুনের মামলার খালাস ঠেকাতে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। তদন্তব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে যে পুলিশের বাইরে একটি স্বাধীন ও দক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনও এ প্রস্তাব দিয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।
বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হবে। মামলার রায় দিতে এক দশকের বেশি সময় লাগলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। আলাদা ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ আদালত এবং সময়সীমাবদ্ধ বিচারিক প্রক্রিয়া চালু করা দরকার। সাক্ষী সুরক্ষা আইন কার্যকর করতে হবে। সাক্ষীরা ভয়ভীতি বা প্রলোভনে পড়লে সত্য সাক্ষ্য দেওয়া সম্ভব হয় না। সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে খুনের মামলার সাজার হার বাড়বে।
বিচারপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করা অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব খাটিয়ে খুনের মামলার বাদীকে সমঝোতায় বাধ্য করার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।
একটি সভ্য সমাজে খুনের মতো অপরাধের বিচার নিশ্চিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে পারে না। অর্ধেকের বেশি আসামি খালাস পাওয়া মানে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। খুনের বিচার শুধু ভুক্তভোগী পরিবারের অধিকার নয়; এটি একই সঙ্গে আইনের শাসনের প্রশ্ন, সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। খুনের মতো অপরাধে দায়মুক্তির সংস্কৃতি যদি এখনই রোধ করা না যায়, তবে তা কেবল বিচারব্যবস্থাকে নয়, গোটা সমাজকেই আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে।
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).
This petiton does not yet have any updates
At 10,000 signatures, this petition becomes one of the top signed on amarabedon.com!
By signing you are agree to the followingTerms & Condition and Privacy Policy.
Reasons for signing.
See why other supporters are signing, why this petition is important to them, and share your reason for signing (this will mean a lot to the starter of the petition).